আমার বাবা, আমাদের চার সদস্যবিশিষ্ট পরিবারের মাথা
(আমাদের চন্দ্র, সূর্য, আলো, বাতাস, অক্সিজেন) যদিও আমার বাবা কোন নামি-দামী
ব্যক্তিত্ব নয় (কখন কখনও বেকার)তবুও প্রায় সময় মনে হয় বাবাকে নিয়ে অনেক কিছুই
লিখি। প্রথমদিকের কথা বলি- আমাদের বাড়িতেই একটা ছোট মুদি দোকান ছিল, যত সম্ভব সেই
দোকানের চৌকাঠ ডাঙ্গানোর খুব কম চেষ্টাই করতাম (শুধু স্কুল বের হওয়ার সময় কিংবা
খুব বাধ্য হলেই কেবল যেতাম)বাবাকে দেখলেই মনে হতো সমস্ত রাগ, ভয়, শাসন আর গাম্ভীর্য
তাকে সর্বদা আড়াল করে রেখেছে কিন্তু এতকিছু হলেও একরাশ নিরাপত্তা আর এক আকাশ
নির্ভরতার কেন্দ্রও হচ্ছে আমার বাবা। ছোটবেলায় যেদিন যেদিন বাবা আমাকে পড়াতে
বসাতেন সেদিন সেদিন আমার কপালে মাইর অবধারিত থাকত এজন্যই হইত বাবার কাছে থেকে একটু
দূরে দূরেই থাকার চেষ্টা করতাম। এরপর জীবনে কিছু টানাপোড়ানের সময় (অনেকটা
ট্রাজেডির মতো) অতিক্রম করেছে আবার নতুন করে বাজারে মুদির দোকান দিয়ে তা থেকে
উত্তরণও করেছে, এই সময়টা খুব দারুণ ছিল (বাবা সারাদিন দোকানের কাজে আর আমরা মেতে
উঠতাম হৈ-হুল্লোড়ে) কিন্তু যখন সন্ধ্যা নামতো আবার এই মাটি আর টিনের বাড়িতে নেমে
আসতো শুনশান নীরবতা। হা-হা, হি-হি বন্ধ, হাত-পা ধুয়ে বসে যেতে হতো পড়ার টেবিল নামক
কুখ্যাত এক জায়গাতে)কিন্তু কি আশ্চর্য! একটু বড় হতে হতেই বাবার সেই রাগ সেই শাসন
হুট করেই কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। অবশ্যই বড় হয়ে আমিও বুঝতে পেরেছি জন্মের দিনই যে
মানুষটা তার মাকে হারিয়েছে, যে মানুষটার বাবা নতুন নতুন সংসার নিয়ে মেতে উঠেছে
তাকে তার ফুফুর কাছে ফেলে রেখে দিয়েছে, বাঁচার মতো কোন অবলম্বনও যে মানুষটা পায়নি
সে মানুষটা একটু বদরাগি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। মাঝে মাঝে বাবাকে দেখে এতোটা অসহায়
মনে হতো! মনে হতো জন্মই যেন এই মানুষটার আজন্মের পাপ হয়ে গেছে (এতকষ্টগুলা মেনে
নিয়ে দিব্যি বেঁচে আছে) । সময়ের সাথে সাথে আস্তে আস্তে অনেক কিছুই পাল্টাতে শুরু
করেছে, এই যেমন ধরেন ২০১১-১২ সালের দিকে খুব রাত করে বাসাতে ফিরতাম, সন্ধ্যার পর
বন্ধুদের সাথে আড্ডাতে বসলে আড্ডা যেন ফুরাতেই চাইতোনা। রাত ২টা ৩টার দিকে আড্ডা
শেষ হলে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে চিন্তা করতাম আজকে বুঝি আমার খবর হয়ে যাবে। বাড়ির
বাইরে থেকে বুঝার চেষ্টা করতাম বাবা জেগে আছে নাকি ঘুমিয়ে গেছে, এটা কিন্তু বাবার
ভয়ে না কারণ আমি জানতাম বাবা ঘুমিয়ে গেলে মা আমাকে এক হাত নিবে এই ভেবে। পড়ালেখার
ক্ষেত্রেও তাই- গণিত নিয়ে পড়ার ইচ্ছে যদিও আমার আগে থেকেই ছিল কিন্তু বাবার
সাপোর্ট ছিল যে আমার কাছে যেটা ভাল সেটাই যেন করি। এখনতো আমার বাবাই আমার পরম বন্ধু, সমস্ত স্বপ্ন আমাদের দুই
ভাইকে নিয়েই দেখে (বলে আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন)এখন সন্ধ্যার পর বাসাতে বাবা এলে
তবেই বাসাটা হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠে, বাবা না থাকলেই আগের সেই টিন আর মাটির বাড়িটা শুনশান
হয়ে যায়। বাবা আছে বলেই মাথার উপরে ছাতা আছে, বাবা আছে বলেই আজও মায়ের চুড়ি-ফিতার
বায়না বেঁচে আছে, বাবা আছে বলেই জান্নাত আছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন