ইরাজ আহমেদ
কতকাল ধরে ডাকছি, ডাকছি তোমাকেই
হারানো নাম। কতকাল ধরে হেমন্তের হাওয়ায় সে নাম উড়ছে, পুড়ছে বুকের ভেতর। একটা শূন্য রেলস্টেশন
থেকে, অচেনা কোনো গাছের শরীর থেকে, ম্লান জানালার কিনার থেকে ডাকছি তোমাকে। নাম হারিয়ে যায় সংসার থেকে। বুকের ভেতর থেকে যায় কি? সংযোগ বিচ্ছিন্ন
হয় মানুষ। হেমন্তের সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশে জ্বলে
থাকা কোনো নক্ষত্র তো আলো পাঠাতে ভুল করে না এই পৃথিবীতে! তবুও
মানুষ ভুলে যায়। এই সংযোগহীনতার আরেক নাম তো মৃত্যু, হয়তো বিচ্ছিন্নতা।
মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষের জীবন কতকগুলো বিচ্ছিন্নতার যোগফল। আয়ুষ্কালে কেবল
বিচ্ছেদ, কেবল বিয়োগ। হারিয়ে যাওয়া নামের ভিড়। কিন্তু
সব নাম কি ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাবার মতো? অন্যমনস্ক মনের প্রান্তরে খসে পড়া
কোনো পাতা, উল্টে যাওয়া বইয়ের পৃষ্ঠা? জীবনে কোনো কোনো নাম আছে যা অবচেতনে
ডাকতে ডাকতে অভিমানী বালকের মতো মন এই জীবন অতিক্রম করে। অতিক্রম করে
তার আয়ুষ্কাল।
সেই নামের কথা
লিখতে বসে ভোরবেলা যেন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলো, আলো ফুটল না আকাশে, গলির মুখে কোনো
বাড়ির ছায়ায় একা বসে থাকল নিঃসঙ্গ কুকুরটা। এ রকম হয় মাঝে মাঝে। নাম
ফিরে আসে হারিয়ে যাওয়া গন্ধ নিয়ে, স্মৃতি নিয়ে, মৌন পাহাড়ের অনুভূতি নিয়ে। ফিরে আসে কতকাল আগের সব ছবি, ভুলে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কারও ছায়া। ভুলে যাওয়া সম্ভব তাকে? সেই নাম, সেইসব মিলিত অক্ষর
কি অর্থ বহন করে আজও? কিছু একটা অর্থ বহন তো করে নিশ্চয়ই। তা না হলে এই কাহিনীর
অবতারণা কেন? তার কথা বলতে শুরু করি, না হলে অবতারণার
চক্করেই সব ফুরিয়ে যাবে।
হেমন্তের বিকেল বড্ড স্বল্পায়ু। শুরু
হয়েই ফুরিয়ে যেতে চায়। এইসব বিষণ্ন বিকেল কি সন্ধ্যার অন্ধকারে আত্মহত্যা
করতে যায় কি-না কে জানে? তবে স্মৃতি যে আত্মহত্যা করতে চায় আজকাল বুঝতে পারি।
হয়তো স্মৃতিরাও ভাবে, কী লাভ এই মনে পড়ার খেলা খেলে? ভুলে যাওয়া নাম তো
কবেই হারিয়ে গেছে রাতের বেলা কোনো ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়া প্রাচীন জোনাকির
মতো। কিন্তু তারপরেও মনে পড়ে। মনে পড়তেই হয়। সেই ভুলে যাওয়া নামের সঙ্গে
কবে দেখা হয়েছিল আজ স্মৃতি হাতড়ে ঠিক মনেও করতে পারি না। কিন্তু দেখা হয়েছিল
আমাদের কোনো এক বসন্তকালে। কথাটা অনেকটা পুরনো রোমান্টিক গল্পের মতো
শোনাল। সত্যি সত্যি তখন সময়টা বসন্তকালের সূচনা ছিল। এই শহরে তখন ফুল
ফুটত, ঝরা পাতায় পথ ছেয়ে থাকত, সন্ধ্যা হলে তারার মতো নির্জনতা ফুটে
উঠত। বলছি এখন থেকে তিরিশ বছর আগের কথা। ভুলে যাওয়া সেই নামের সঙ্গে দেখা
হয়েছিল আমার। একটু আগেই লিখছিলাম ভুলে যাবার প্রতিযোগিতার কথা। আসলেই কি
মানুষের মন এ রকম প্রতিযোগিতায় নামে? মন কিন্তু সমুদ্রের মতো, কিছুই সেখানে
একেবারে হারিয়ে যায় না। একদিন সব ফিরে আসে। মানুষ আসলে ভুলে থাকার
চেষ্টা করে। মনের সংসার ফাঁকি দিয়ে চলে বাইরের সংসারকে। কিন্তু ভুলে যাওয়া
নাম তো সত্যি সত্যি ভুলে থাকা কঠিন কাজ। সেই যে ভুলে যাওয়া নামের সঙ্গে
কবে দেখা হয়েছিল। সবকিছু কি ভুলে থাকা গেল? একদিন খুব বৃষ্টি পড়েছিল, একদিন সবকিছু
রৌদ্রে উদ্ভাসিত ছিল, একদিন ইমন, ভৈরবীতে টান লেগেছিল, সব তো মনের কাছেই
পড়ে আছে। কখনও ভালোবাসা হয়তো এমনই, একদিন শুরু হয় মনে রাখার মন্ত্রে, আজ ভুলে যাবার মন্ত্র। ভুলে যাওয়া নাম কি কখনও ভেবেছিল সে নিজেই একদিন চলে যাবে মনের বিরূপ প্রান্তরে? জড়িয়ে যাবে মনে না রাখার কঠিন শর্তে? প্রেমে পড়ার সঙ্গে আসলে অনেক শর্ত জড়াজড়ি করে থাকে, থাকতে চায়। তারপর একদিন খেলা ভাঙে, প্রতিশ্রুতির মালা
পড়ে থাকে পথের ধুলায়। দু'জন মানুষের পথ আলাদা হয়ে যায়, স্বপ্ন আলাদা হয়। কিন্তু তারপর? তারপর তো আরও
খানিকটা গল্প বেঁচে থাকে। সে তো ভুলে থাকা কোনো নাম মনে পড়ে যাওয়ার
গল্প।
ভুলে যাওয়া সেই নামের সঙ্গে দেখা হয়েছিল
ভিড়ের ওপর ভাসতে থাকা মতিঝিলে। চারদিকে সেদিন ঝকঝক করছে রোদ, হু হু হাওয়া। মনে
আছে, সে দিনটা যেন হাওয়ার ওপর ভর করেছিল। কে জানে, হয়তো হাওয়াই দু'জন মানুষকে উড়িয়ে
এনেছিল নিয়তির মতো। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর সেই প্রথম দেখা। ভিড়ের মধ্যে
আচমকা খুলে দেওয়া খুব একটা রঙিন ছাতার মতো ছিল দৃশ্যটা। চারপাশে মানুষের
কণ্ঠস্বর, বাসের অস্থির হর্নের আর্তনাদ, ফেরিওলার হাঁক- সব
কেমন নিমেষে একটা গভীর নৈঃশব্দের মাঝে ঢুকে পড়ল। ভুলে যাওয়া নাম তখন কপালে
একগোছা অবাধ্য চুল সরাতে ব্যস্ত। আমি ব্যস্ত অবিন্যস্ত নিজেকে গুছিয়ে
নিতে। মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন তখন পথ খুঁজছে বের হয়ে আসার। শুধু সামান্য হাসি
বিনিময় সেদিন ছিল সংযোগ সেতু। ছোট দু-একটা প্রশ্ন, দু-একটা উত্তর।
তারপর ভিড়ের ভেতরে, অনন্তকালের হাওয়ার ভেতরে অনেক কথা, অনেক প্রশ্ন
ঘুরপাক খেয়ে ফিরে গিয়েছিল। কোথাও কফি খেতে যাইনি, কোনো নির্বাচিত আড়ালও খুঁজে নিইনি। ওই
ভিড়ের পথের ওপরই বিদায়, বিদায়। দু'জন মানুষ আবার মানুষের ভিড় কেটে ফিরে
গিয়েছিল নিজস্ব পথে। কিন্তু আজ অনেকটা সময় পার হয়ে লিখতে বসে
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে মন চাইছে। সংক্ষিপ্ত অগ্ন্যুৎপাতের মতো সেই
একটি দিনে আমার মন কী দেখতে চাইছিল তা আজ বলে ফেলতে ইচ্ছে করছে। সত্যি সেদিন
দেখতে চেয়েছিলাম, জানতে চেয়েছিলাম ভুলে যাওয়া নামের ভালো না
থাকার জবানবন্দি। আমার বিশ্বাসঘাতক মন জেনে নিতে চেয়েছিল তার নতুন এই জীবনের
বেদনা-কাব্য। অনুমান করে নিতে চেয়েছিল তার মনের মধ্যে আজও আমার জন্য
জমিয়ে রাখা দীর্ঘশ্বাসের পরিমাপ। মন খুব বেশি করে বুঝে নিতে চেয়েছিল সে ভালো
নেই, সে ভালো নেই।
উত্তরটা মিলেছিল সেদিন? না। তারপর হাহাকার
নিয়ে ঘরে ফেরা, ফেরা সেই একই বৃত্তাবদ্ধ জীবনে। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়
ভুলে যাওয়া সেই নামও কী জানতে চেয়েছিল একই উত্তর? মন আসলে এমনই
হয়তো। ফুরিয়ে যাওয়া সম্পর্ককে একটা দরজা-জানালা ছাড়া ভাঙা বাড়ির মতো করেই
দেখতে চায়। শুনতে চায় সেই অস্তিত্বের মাঝে হাওয়ার একটানা আর্তনাদ। আমিও
তেমনটাই চেয়েছিলাম। দেখতে চেয়েছিলাম আমি খেলতে পারিনি বলে খেলাটাই ভেঙে গেছে।আক্ষেপ
দিয়ে নতুন করে লিখতে চেয়েছি সেই ভুলে যাওয়া নামের বানান। প্রাণপণে ভুলে যেতে চেয়েছি সব। কিন্তু পেরেছি কি? আসলে ভুলে যাওয়া নাম কখনোই ভুলতে পারা যায় না। এক অভিমানী বালকের মতো মন তাকেই খুঁজতে থাকে হারানো খেলনা ভেবে। তাই এই শহরের ভিড়ের মধ্যে, রাত্রিবেলা শূন্য পথে, আলোয়, ছায়ায় খুঁজে ফেরা তাকে। ভুলে যাওয়া নাম সংসারের ছায়ার মধ্যে মরে যায়। মরে যায় পাথর চাপা ঘাসের মতো। সত্যিই কি মরে? ভুলে যেতে চাইলেই কি ভুলে যাওয়া নাম বিদায় নেয় জীবন থেকে? না, বিদায় নেয় না। কোনো বৃষ্টি আসি আসি ভোরবেলা, কোনো এক ব্যস্ত দিনে অনেক রোদের মধ্যে, হেমন্তের মরে আসা বিকেলে ভুলে যাওয়া নাম ঝাঁপ দেয় ফিরে। উল্টে যায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পেছনের দিকে। ভুলে যাওয়া নামের
সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি। তবু নাম ধরে ডাকি, ডাকতে থাকি আড়াল থেকে।
জানি, ভুলে ভরা একটা গল্পে নামটাও ভুল হয়, সংশোধনের সুযোগ থাকে না।