বরাবরের মত আজকেও অভ্রর খুব
সকালে ঘুম ভেঙ্গেছিল কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে মন করেনি তার, বালিশের পাশে রাখা মোবাইলটার ডিসপ্লে চালু করে
দেখে নিলো ছয়টা বেজে বিশ মিনিট মানে অফিসের টাইম হতে এখনও দুই ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট বাঁকি,
আবার আরামে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। ঠিক আটটা চল্লিশে ঘুম ভেঙ্গে দেখে গতদিনের ক্লান্তিটা আজ আর
নেই, এমন এক চাকুরী অভ্রর কপালে জুটেছে যে আগে থেকে
বোঝার উপায় নেই আজকে রোগীর চাপ থাকবে নাকি থাকবেনা। তবে এটাও ঠিক যে আগের চাকুরীর চেয়ে এটা ঢের ভাল, অন্তত অতিমাত্রার
ধারাবাধা নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়না। আসলে অভ্রর জীবনটা অল্প
একটু গুছানো বাঁকিটা ভাদ্রের মেঘের মতো এলোমেলো, অথচ আষাঢ়ের মেঘের মতো জমাট বাধার কথা ছিল কিন্তু বাঁধেনি,
তবে এর অর্থ এই নয় যে আষাঢ় আসেনি, আষাঢ় এসেছিল
জমাট বাধা মেঘ নিয়ে বলেই আজ ভাদ্রে সেই মেঘ এলোমেলো। আবার নতুন করে আষাঢ়ে মেঘের স্বপ্ন আঁকে- জমাট বাঁধা স্বপ্ন, লাল,
নীল, বেগুনী। অফিসে এসে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে অভ্র, আজকে তার মোবাইলটা হাতে নিতে ইচ্ছে করছেনা অথচ
এই সাধের মোবাইল ঘিরেই আড়ালে, আবডালে কত কথা হয়, স্যার হয়ত বউ ছাড়া থাকতে পারবে কিন্তু মোবাইল ছাড়া নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকে অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে কাজের চাপ কম সকালটাই নাকি সারাদিনের
পূর্বাভাস দেয়, শরতের মেঘের মতোই নিজেকে
অনেকটা হালকা মনে হচ্ছে অভ্রর। যে সহকর্মীটা সারাদিন অভ্রর পেছনে লেগে থাকে সে এসে বসল সামনের
চেয়ারে, মুখে তার বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট। মাথা নিচু করে কারণটা স্পষ্ট করল আবিদ, তার
বদলি হয়ে গেছে চট্টগ্রাম ইউনিটে। খারাপ লাগছে তার, লাগবেইনা বা কেন? গত ছয়মাস
অভ্রর পেছনে লেগে থেকে আজ তাকেই বিদায় নিতে হচ্ছে সেটাও আবার প্রাইভেট চাকুরীতে।
এর মধ্যেই ইরশাদ এসে দরজা থেকে বলে গেল ম্যানেজার আপনাকে স্মরণ করেছে, ঝাড়া পায়ে
ম্যানেজারের রুমের দিকে পা বাড়াল অভ্র, খবরটা কি?
- -জ্বী স্যার, ভাল।
- - কাজের খবর কি?
- -ভালো, কোন কাজ জমা পড়ে নেই।
- -ওহ, তাহলে তো ভালই। আপনারও কাজ নেই আমারও নেই চলুন বাইরে
গিয়ে কোথাও চা বা কফিটফি কিছু খেয়ে আসা যাক। অভ্র আজকে অনেকটা আশ্চর্য হয়ে গেছে যে
ম্যানেজারের রুমে গেলে বসতে পর্যন্ত বলেনা তার মুখে আজকে এমন কথা শুনে আশ্চর্য
হবারই কথা। কি জানি, হয়ত ফেসবুকে কোন অল্প বয়সীর সঙ্গে ভাবসাব হয়েছে হয়ত।
ফেসবুকে অল্প-বয়সীর সাথে ভাবসাব কথাটা মনে আসার পর থেকেই মাথার ভেতরে রুম্পার
কথা ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে অভ্রের। রূম্পা”, নাহ কোন অল্প বয়সী কেও না তবে অধিক
বয়সীও না। কোন একদিন এই ফেসবুকেই পরিচয় হয়েছিল দুরন্ত সেই রুম্পার সাথে। কফির
কাপটা হাতে নিয়ে আনমনা হয়ে গেছে সে, হাত থেকে সিগারেটের ছাইটা নিচে পরে যাওয়াতে চেতনা
ফিরে আসে। মনে মনে আবিদকে একটা ধন্যবাদ জানায় সে, বদলি হয়ে অন্তত ম্যানেজারের
কাছাকাছি আসার সুযোগ করে দিয়েছে। আসলে আবিদকে বদলি করা হয়েছে, সত্য কখনও ডানে-বামে
হেলেনা। মালিক পক্ষের আত্মীয় না হলে নির্ঘাত চাকরিটা তার যেত কিন্তু তার আগেই এমডি
তার বদলির অর্ডার করে দিয়ে গেছে। এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে আবার অন্য মনস্ক হয়ে গেছে
আবিদ, কেও কথা বলছেনা, শুধু রোড দিয়ে অটো আর এ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ। এবার
ম্যানেজারের ম্যাসেঞ্জারের শব্দে নীরবতা ভঙ্গ হয় ততক্ষণে ম্যানেজারের মুখে একচিলতে
হাঁসি, এ হাঁসি সন্দেহের হাঁসি, এই হাঁসি অজানা কিছু পাওয়ার হাঁসি। কফি শেষ করে যে
যার নিজের কাজের জায়গায় চলে যায়, অভ্রর মুখটা আজকে আনন্দে চকচক করছে ২ মে রুম্পার
জন্মদিন, সেই সুযোগে একবার বাসা থেকে ঘুরে আসা হবে। বাসার কথা মনে পড়তে মা, বাবা,
ছোট ভায়ের চাতকের মতো মুখগুলা ভেসে এসে চোখটাকে হালকা ঝাপসা করে দিয়ে যায় অভ্রের।
আজ ২মে। রুম্পার জন্মদিন, রূম্পা অভ্রের সাথে দেখা করতে পারবেনা সেকথা আগেই
জানিয়ে দিয়েছে, হতে পারে এটা তার জেদ আবার এমনও হতে এটা তার অহঙ্কার, তার কাছে
অহঙ্কার করার মতো অনেক কিছুই আছে যেটা অভ্রের কাছে নেই। তবুও সুন্দর একটা মোড়কে
বইটা হাতে করে ঠিক সেই জায়গাটাতেই এসে অভ্র দাঁড়িয়েছে যেখানে তাদের প্রথম দেখা
হয়েছিল, জায়গাটা আগে মোটামুটি শুনশান ছিল এখন সেখানে হোটেল হয়েছে, ক্যাফে হয়েছে
সর্বোপরি সবকিছুর পরিবর্তন হয়েছে।আসবেনা জেনেও অপেক্ষার কোন মানে হয়? হয়ত হয়, হয়ত
হয়না। এই জায়গাতেই মুখ ঢেকে দাঁড়িয়েছিল রুম্পা, দাঁড়িয়েছিল বললে ভুল হবে যা দুরন্ত
টাইপের মেয়ে! স্থির দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয় আবার যদি ইচ্ছে করে তাহলে ঠাই
দাঁড়িয়ে থাকবে যা জেদি! এ হচ্ছে তার চঞ্চলতা, চপলতা যে চপলতা হালকা নাড়িয়ে দিয়েছিল
অভ্রকে। মুগ্ধ হয়ে সেদিন লম্বা, সাদা আঙ্গুল নাড়িয়ে কথা বলার তীক্ষ্ণতা দেখেছিল
অভ্র তারপর প্রায় তিনবছর হয়ে গেছে আর কখনও দেখা হইনি। তিন ঘণ্টা হয়ে গেছে অভ্র
দাঁড়িয়ে আছে রুম্পার অপেক্ষায়, উত্তেজনায় জনসম্মুখেই সিগারেট জ্বালিয়েছে পুড়তে আছে
সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা আর অভ্র নিজেই। চার ঘণ্টা পরে রুম্পা এলো, আনন্দে মুখটা
উজ্জ্বল হয়ে গেল অভ্রের, চোখটা চকচকে হয়ে উঠেছে, নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছেনা সে। তবে
সেই চকচকে ভাব বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়ে উঠেনি। মেসে রবিউলের কাছে ৩৫০ টাকা ধার করে
রুম্পার পছন্দের বইটা কিনেছিল অভ্র, চাকরী করলেও মাসের শেষ দিকে হাতে টাকা থাকেনা
ঠিক সেই সময়ে ঢাকা যেতে হয়েছিল তাই বইটাও কিনে এনেছিল ধার করা টাকায়। সেই বইটা রুম্পার হাতে দেয়া মাত্রই
ছুড়ে ফেলল অভ্রর পায়ের নিচে, সাথে সাথে লুটিয়ে পড়ল কিছু প্রত্যাশা, কিছু আবেগ,
কিছু ভালবাসা। ৩৫০ টাকা দিয়ে কি ভালবাসা কেনা যায়? সোজা উত্তর- আপনাকে আমি নিষেধ
করেছিলাম না বই নিয়ে আসতে? কেন এসেছেন? কোন অধিকারে এসেছেন? একথাগুলো তার কাছ থেকে
অনেক শুনেছে আজ সরাসরি দেখছে, এটা তার দাম্ভিকতা
তোমার আছে দাম্ভিকতা ভরা মন
আমার আছে ব্যথার আমন্ত্রণ
বাথা! সেতো নিজে থেকেই তৈরি
তোমার আকাশ আলোয় ভরা, আমার আকাশ বৈরী।
অভ্রের দাম্ভিকতা
দেখানোর মতো কিছুই নেই টাকাতো নেই নেই, ঢাকায় বাড়ি নেই, গাড়ী নেই চলে সে পায়ে
হেঁটে, বাসে চড়ে কিংবা রিক্সায় চেপে। নাই কোন দামী প্যান্ট, চামড়ার জুতো, আছে শুধু
দুর্বলতা। অভ্র শুধু অভ্রই, রুম্পা শুধু রুম্পাই, সে বোঝেনি, দেখেনি, সে অন্ধ তার
অহমিকায় অন্ধ।
অভ্র বাড়ি থেকে এসেছে
বেশ কয়েকদিন হলো কিন্তু আজ কোন এক অজানা কারনে অভ্রের মন প্রচণ্ড খারাপ, কেন এই মন
খারাপ? রুম্পার জন্য? যে রুম্পা তাকে কোনদিনও বোঝেনি তার জন্য? এক কথায় এতগুলো
উত্তর দেয়া খুবই সম্ভব। হ্যাঁ,
তার জন্যই। কি? ভেবেছিল কি অভ্র? ভেবেছিল কি? রুম্পা তাকে জড়িয়ে ধরে তার আজীবনের
ভালবাসা ঘোষণা করবে তার জন্য? ভেবেছিল কি, সে তার বসতবাড়ি ছেড়ে দিয়ে হাতে সামান্য
একটা টিনের ট্রাঙ্ক ধরে রাস্তায় নেমে যাবে তার সাথে? বলবে চলেন, চলেন, চিরকাল
থেকেছি আপনারই অপেক্ষায়, আমাকে নিয়ে যান। চলেন দুজন মিলে একটি জীবন গড়ি, বিয়ে করি, ঘর বাঁধি, আমাকে
একটা সন্তানের মা হতে দিন?কতো বোকা ছিল অভ্র! তাই
হয়ত আজ মন খারাপ। এই মন জিনিসটা যে কি? কেন? কোথায় থাকে তাইতো সাতাশ বছর ধরে বোঝে উঠতে
পারেনি অভ্র। তাহলে এই মন খারাপ হয় কিভাবে? বেয়াদ্দব, বেহায়া মন। যে মনকে সে দুচোখে দেখতে পারিনা সেই মন তাকে আঁকরে ধরে রাখে
সারাবেলা তার খপ্পরে।
কেন যে টাকা ধার করে সেদিন
বই কিনতে গেলাম, নিজেকে এভাবে ছোট না
করলেই পারতাম, ৩৫০ টাকা দিয়ে জীবনের সাথে নতুন করে জুয়া না খেললেই
পারতাম। কিন্তু আমি সেটা করলাম যার বিনিময়ে তুচ্ছতা, তাচ্ছিল্যতা,
ঘৃণা, অবহেলা, অবজ্ঞা সবই
পেলাম। আমারতো কিছুই নাই, নাই কোন ভবিষ্যৎ, নাই কোন ঘরবাড়ি সত্যি বলতে কি নিজের
চেহারা-ছবিও নেই। আমি পারিনা দিনকে রাত বানাতে আর রাতকে দিন আমার সেই ক্ষমতাও
নেই, যার আছে রুম্পা তারই হবে, যে জীবনে বোঝেনি সে একটা কেন এক ডজন, দুই ডজন,
তিন ডজন মানবজনম দিলেও বোঝবেনা। রাগ করে ছুড়ে ফেলে দিবে
আমার পায়ের কাছে, ছোট করবে
আমাকে, ছোট একটা
অঞ্চলের, ছোট একটা পরিবারের এই আমাকে। যার কোন ফ্ল্যাট বাড়ি নাই, যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরী নাই, ভবিষ্যৎ নাই
এমনকি চেহারা সুরতও নাই। কি ভেবেছিলাম আমি? শুধু তার চঞ্চলতা? চপলতা?
যেই চপলতার দ্বারা দিনকে রাত আর রাতকে দিন করা যায়। সূর্য যেমন উদিত হয় তেমনি অস্তও যায়। রুম্পা তোমার এই চঞ্চলতা আজীবন থাকবেনা, আমার পায়ের কাছে পড়ে থাকা বইটার মতো নুইয়ে পড়বে,
চলে যাবে তোমার যৌবন, তোমার অহমিকা আর এই চৈত্রের
মেঘের মতো আমার কল্পিত প্রেম। আজ বিমানবন্দরে বসে
একথাগুলোই ভাবছে অভ্র, ফ্লাইটের
দেরী আছে আরও ঘণ্টা খানেক, হাতে তার ভিসা আর পাসপোর্ট। অভ্র আজকে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে হয়ত নিজের থেকেই পালিয়ে যাচ্ছে, লম্বা যাত্রা, রুম্পা
চাইলেই এযাত্রায় সঙ্গী হতে পারতো দুরের পথ একা একা পাড়ি দেয়া খুব কষ্টের তার উপরে আবার
গাছে বাকলের মতো নিজেকে সব মায়া হতে আলগা করে নিয়ে যাওয়া। ধুর, কি ভাবছে এসব অভ্র! চৈত্রের
মেঘ কি কখনও বাস্তব হয়? এতো তার কল্পনা যে কল্পনার শুধু বিষণ্ণতা
আছে পরাজয়ের প্রবনতা আছে।
তোমার আছে অহমিকা, গাম্ভীর্যতা
আমার আছে পরাজয়ের প্রবণতা
পরাজয়! সেতো আমার নিজে থেকেই বরণ করা
তোমার নদিতে বন্যা এখন আমার নদীতে খরা ।